টিভিতে ১৯৮৯ এর ক্লাসিক ধারাবাহিক বি আর চোপড়ার মহাভারত পুনঃসম্প্রচারিত হচ্ছে। সিরিয়ালটা সবারই খুব মন দিয়ে দেখা উচিত। এই মহাভারত সিরিয়ালের পরিকল্পনা যখন চোপড়া সাহেব নিয়েছিলেন তখন সবচেয়ে বড় বিষয় যেটা তাকে চিন্তায় ফেলেছিলো সেটা হলো এই বিশাল এবং জটিল মহাকাব্যকে গল্পের ঢংগে সাধারন মানুষের কাছে পেশ করতে হলে একটা খুব শক্তিশালী এবং মজবুত চিত্রনাট্যের প্রয়োজন। এমনিতে স্ক্রীপ্ট রাইটারের অভাব ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে নেই কিন্তু মহাভারতের আঠারো পর্বের সব ঘটনা পুংখানুপুংখ বিশ্লেষন করে সব চরিত্রের মুখে সংলাপ বসিয়ে চিত্রনাট্য বানানোর মতো সেইরকম পড়াশোনা জানা উপযুক্ত লোক কোথায়? অনেক ভেবে বি আর চোপড়া দেখলেন একজন লোকই এই ভারতবর্ষে আছেন যিনি এই কাজটা নিঁখুতভাবে করতে পারেন। তিনি হলেন বিখ্যাত উর্দু কবি এবং ফিল্ম চিত্রনাট্যকার ডঃ রাহী মাসুম রেজা (ম্যায় তুলসী তেরে আঙ্গন কি, কর্জ এবং ঋষিকেশ মুখার্জীর গোলমাল ওনার স্মরনীয় কাজগুলির মধ্যে অন্যতম)।
বি আর চোপড়া ডঃ রাহী মাসুম রেজার সাথে যোগাযোগ করলেন। রেজা সাহেব সব শুনে বললেন এতো উত্তম প্রস্তাব কিন্তু সমস্যা হলো আবার নতুন করে পড়াশোনা করতে হবে। প্রচুর ধকল আর খাটুনী আছে। এই বয়সে অত ধকল নিতে পারবো না। আর অন্যান্য ফিল্ম সিরিয়ালের কাজও আছে। সময় বের করা মুশকিল। আপনি অন্য কাউকে দেখুন।
এরপরেই সমস্ত নিউজ পেপারে এই সংবাদ খবর হিসাবে বেরিয়ে গেল যে বি আর চোপড়ার মহাভারতের চিত্রনাট্য লেখার প্রস্তাব ডঃ রাহী মাসুম রেজা প্রত্যাখান করেছেন। অমনি কিছু দিনের মধ্যেই চোপড়াদের দফতরে বন্যার মতো চিঠি আসা শুরু হয়ে গেল। উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো লিখলো - একটা মুসলমান ছাড়া মহাভারতের স্ক্রীপ্ট লেখানোর জন্যে আপনি সারা ভারতে আর লোক পাননি? হিন্দুরা কি মরে গেছে? গোঁড়া মুসলীম সংগঠনগুলিও চিঠিতে লিখলো - আপনার সাহস হয় কি একজন মুসলমানকে গিয়ে মহাভারতের স্ক্রীপ্ট লেখার কথা বলবার?
অত্যন্ত বুদ্ধিমান বি আর চোপড়া সমস্ত চিঠি রেজা সাহেবের ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। সমস্ত চিঠির বক্তব্য এবং ভাষা পড়বার পরে রাহী মাসুম রেজা টেলিফোনে চোপড়া সাহেবকে কনফার্ম করলেন এই কথা বলে যে - এইবার মহাভারতের চিত্রনাট্য আমি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ লিখবে না। আমিই লিখবো কারন আমিও গঙ্গাপুত্র ( রেজা সাহেব উত্তর প্রদেশের গঙ্গা তীরস্থ গাজীপুরে জন্মগ্রহন করেছিলেন)।
চিত্রনাট্য লেখার পরে যখন সিরিয়ালের সম্প্রচার শুরু হলো তখন প্রশংসার বন্যায় ভেসে গেলে ডঃ রাহী মাসুম রেজা। অধিকাংশ চিঠিতেই ওনার পান্ডিত্যের প্রশংসা এবং দীর্ঘজীবনের কামনা ছিলো। মহাভারতের যে অসাধারন সম্বোধনগুলো ভীষন জনপ্রিয় হয়েছিল যেমন - মাতাশ্রী, পিতাশ্রী , ভ্রাতাশ্রী , তাৎশ্রী এই শ্রী যুক্ত সম্বোধনগুলো আগে কোন ধার্মিক কাহিনীতে ব্যবহৃত হয়নি। এটা ডঃ রাহী মাসুম রেজার এক স্মরণীয় কীর্তি।
কি অনবদ্য সংলাপ আর টানটান চিত্রনাট্য ছিল। কত সুন্দরভাবে মহাভারতএর জটিল জায়গা গুলোকে তুলে ধরেছিলেন। কোথায় সংস্কৃত শব্দ ব্যাবহার করতে হবে আবার কোথায় হিন্দী শব্দ ব্যবহার করতে হবে তারও এক দুরন্ত নমুনা পেশ করেছিলেন রেজা সাহেব। কুন্তী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নাজনীন , আর অর্জুনের চরিত্রে ফিরোজ খান। সামসুদ্দীন হয়েছিলেন বকাসুর। এটাই ভারতবর্ষ ।
রেজা সাহেব সমস্ত চিঠিগুলোকে বান্ডিল করে করে বেঁধে রাখতেন। এই রকম অনেক বড় বড় চিঠির বান্ডিল ওনার ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে রাখা থাকতো। একদিন এক সাংবাদিক যিনি রেজা সাহেবের কাছে ওনার সাক্ষাৎকার নিতে গেছিলেন তিনি একদম আলদা করে ঘরের কোনায় রাখা একটা ছোট্ট চিঠির বান্ডিলের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে রেজা সাহেবকে প্রশ্ন করলেন - এই ছোটো চিঠির বান্ডিলটা আপনি আলাদা করে রেখেছেন কেন?
- ওটা স্পেশাল বান্ডিল। উত্তর দিলেন রেজা সাহেব।
- স্পেশাল কেন? কি আছে ওতে? -
- ওটাতে উগ্র হিন্দু এবং মুসলীম সংগঠনগুলোর তরফ থেকে মহাভারতের চিত্রনাট্য লেখার জন্যে আমাকে থ্রেট এবং গালাগাল করা হয়েছে। তাই আলাদা করে রেখেছি।
তারপরে রেজা সাহেব বললেন - এত বড় বড় বান্ডিলের মধ্যে এই গালাগাল এবং হুমকি চিঠির ছোটো বান্ডিলটা দেখে তিনি প্রেরনা পান এবং এটা ভেবে উৎসাহিত হন যে আমাদের দেশে নোংরা চিন্তা করা মানুষের সংখ্যাটা ভালো এবং শুভচিন্তা করা মানুষের তুলনায় অনেক কম।
এই ঘটনা কিন্তু আজও আমাদের একটা শিক্ষা দেয় যে এখনো চারদিকে যারা সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়াচ্ছে তাদের তুলনায় শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের সংখ্যাটা এখনো অনেক অনেক বেশী সেই জন্যেই দুনিয়া চলছে।
ডঃ রাহী মাসুম রেজা একটি ইন্টারভিউতে বলেছিলেন যে - আমার স্বধর্মের লোকেরা আমাকে বলে ও মুসলমান নয় আবার অন্য ধর্মের লোকেরা বলে ওতো মুসলিম কিন্তু আমার কাছে কেউ জানতে চাইলো না যে আমি কি!!
( সংগৃহীত)